‘পরম সময়’ এর ধারণা একটা বিভ্রম। পদার্থ বিজ্ঞান ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এর উত্তর জানা যায়।
আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দেয়ার পর থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি অভিকর্ষজ বলের, স্থান ও সময়কে বাঁকিয়ে ফেলার ক্ষমতা আছে।
স্টিফেন জনসন
বিগ থিংক, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯
এই ‘সময়ের প্রসারণ’ এর প্রভাব খুব ক্ষুদ্র মাত্রায়ও ঘটে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে, সময়কে উপলব্ধি করার সময় আমরা এর বিকৃতি অনুভব করি, কখনও স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মত পর্যায়ে ।
ঘড়ি পরীক্ষা
পাহাড়ের চূড়ায় একটা ঘড়ি রাখুন। এবার আরেকটা ঘড়ি রাখুন সমুদ্র সৈকতে। একটা পর্যায়ে এসে দেখবেন দুইটি ঘড়ি আলাদা সময় দিচ্ছে। কেন? আপনি পৃথিবীর যত কাছে যাবেন তত সময় আস্তে চলবে কারণ আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বলেছিলেন, বিশাল ভরের কোনো বস্ত যেমন পৃথিবী তার অভিকর্ষজ (পৃথিবীর ক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণ) বলের মাধ্যমে চারপাশের সময় এবং স্থানকে বাঁকিয়ে ফেলে।
সময়ের প্রসারণ
বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে মহাজাগতিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম ‘সময়ের প্রসারণ’ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, যখন একটা নক্ষত্র ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরকে অতিক্রম করে। এরপর ২০১০ সালে গবেষকরা এই একই ঘটনা অনেক ক্ষুদ্র পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করেন যখন অত্যন্ত নিখুঁত সময় দিতে পারে এমন দু’টি আণবিক ঘড়ির একটিকে আরেকটির চেয়ে ৩৩ সেন্টিমিটার কম উচ্চতায় রাখা হয়। এখানেও দেখা যায় পৃথিবীর কাছে থাকা ঘড়িটিতে সময় আস্তে চলছে।
পার্থক্য অতি সামান্য। কিন্ত এর অর্থ বিশাল, পরম সময় বলে কিছু নেই।
পৃথিবীর প্রতিটি ঘড়ির জন্য এবং প্রতিটি মানুষের জন্য সময় ভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয়। কিন্ত যদি পুরো মহাবিশ্বে সময়ের গতি এমন ওঠানামা করে থাকে, তাহলে সময় নিশ্চয়ই একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এভাবে চলতে থাকে, তাই কি? নাও হতে পারে।
আরো পড়ুন: কেন আমরা মিথ্যায় বিশ্বাস করি—বিল গেটস, রাশিদা জোন্স ও ইউভাল নোয়াহ হারারি’র আলাপ
সময় কি আসলেই সবসময় সামনের দিকে প্রবাহমান?
ইতালীয় তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী কার্লো রোভেলি তার ‘দি অর্ডার অফ টাইম’ বইয়ে মতামত দেন, সময় নিয়ে আমাদের যে ধারণা—আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে মনে হওয়া সময় সর্বদা সামনের দিকে প্রবহমান—এটা হতে পারে কেবলই একটা ব্যক্তিনির্ভর ধারণা। কারণ যখন ক্ষুদ্রতম পর্যায়ে বাস্তবতাকে দেখতে চাইবেন (কোয়ান্টাম অভিকর্ষজের সমীকরণ ব্যবহার করে) আপনি দেখবেন সেখানে সময় বলে কিছু থাকে না।
“যদি আমি আণবীক্ষণিক পর্যায়ে বস্তুসমূহ পর্যবেক্ষণ করি, সেখানে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না… বিষয়টা বস্তুসমূহের প্রাথমিক ব্যাকরণ দিয়ে বোঝাতে গেলে বলতে হয়, তখন কারণ ও প্রভাবের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না”, রোভেলি লেখেন।
এন্ট্রপি
তবে কেন আমরা সময়কে সামনে প্রবাহিত হতে দেখি?
রোভেলি বলেন, “যদিও ক্ষুদ্র পর্যায়ে সময়ের অস্তিত্ব থাকে না, আমরা বাস্তবে ঘটনাসমূহকে পর্যায়ক্রমে হতে দেখি। অন্য ভাষায় বলা যায়, আমরা এন্ট্রপি পর্যবেক্ষণ করি। শৃঙ্খলা পরিণত হয় বিশৃঙ্খলায়। একটা ডিম ভেঙে যায় আর অজস্র অংশে পরিণত হয়।”
রোভেলির মতে তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্র সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বর্ণিত করে। সেখানে বলেছে, তাপ সব সময় উষ্ণ বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে প্রবাহিত হয়। এটা একটা একমুখী রাস্তা। যেমন একটা বরফ খণ্ড এক কাপ গরম চা’য়ে গলে যায়। কখনো এর বিপরীত হয় না।
রোভেলি ধারণা দেন, এই একই ধরনের ঘটনা ব্যাখ্যা দিতে পারে কেন আমরা কেবল অতীতকে উপলব্ধি করতে পারি কিন্ত ভবিষ্যৎকে পারি না। “যখনই ভবিষ্যৎকে নিশ্চিতভাবে অতীত থেকে আলাদা করা যায়, এর মধ্যে তাপের ভূমিকা আছে”, ফিনানশিয়াল টাইমসে রোভেলি লেখেন।
তাপগতিবিদ্যা সময়ের গতিপথকে ‘অতীতের নিম্ন এন্ট্রপি’তে খোঁজ করে, এটা একটা রহস্যময় ঘটনা যা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে।
আরো পড়ুন: আইজাক আসিমভ: কীভাবে মানুষ নতুন আইডিয়া পায়?
তিনি আরও বলেন, “এনট্রপি বৃদ্ধি সময়কে নির্দেশ করে ও অতীতের চিহ্নগুলির অস্তিত্বের অনুমতি দেয়। সেগুলি অনুমতি দেয় স্মৃতির সম্ভাবনাকে, যা আমাদের পরিচয়ের অনুভূতিকে একত্রিত করে। আমার সন্দেহ হয় যেটাকে আমরা সময়ের ‘প্রবাহ’ বলি, একে বুঝতে হবে আমাদের মস্তিষ্কের গঠন বোঝার মাধ্যমে, পদার্থবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমে নয়। বিবর্তন আমাদের মস্তিষ্ককে এমন একটি যন্ত্রের রূপ দিয়েছে যেটা স্মৃতি ব্যবহার করে থাকে ভবিষ্যৎকে অনুমান করার জন্য। আমরা যখন সময়কে প্রবাহিত হতে দেখি তখন আমরা এটাই দেখি।
সময়ের প্রবাহ
‘সময়ের প্রবাহ’ বুঝতে পারা তাই এমন কিছু একটা যেটা যতটা না মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত তার চেয়ে বেশি নিউরোসাইন্সের সাথে সম্পর্কিত। পদার্থবিজ্ঞানের কাছ থেকে সময় প্রবাহের উত্তর খুঁজতে চাওয়া হয়তো ভুল হতে পারে।”
পর্বতের চূড়ার চেয়ে সমুদ্র সৈকতে সময় ভিন্ন গতিতে চলে। কিন্ত সময়ের এমন অদ্ভুত বিকৃতি বোঝার জন্য আপনার কোনো ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। উদাহরণে বলা যায়, যখন মানুষ জীবন-মৃত্যুর সংকটে পড়ে, মস্তিষ্ক প্রচুর পরিমাণে এড্রেনালিন নির্গত করে যেটা দেহের ভেতরের ঘড়িকে দ্রুত করে দেয়, ফলে আপনার কাছে মনে হয় বহির্জগতে সময় আস্তে চলছে।
সময়ের ওপর আমাদের মনোযোগের প্রভাব
সময়ের আরেকটি বিকৃতি যেটা আমাদের খুব চেনা, সেটা ঘটে যখন আমরা কোনো বিষয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করি। যদি আপনি সময় কীভাবে প্রবাহিত হচ্ছে সেটা নিয়ে ভাবতে চান, তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই বিষয়টা আপনার সময়ের ধারণাকে প্রভাবিত করে তা হচ্ছে মনোযোগ।
অ্যারন স্যাকেট, ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট থমাসের মার্কেটিং বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর গিজমোডো ডটকমকে জানান, “যতই আপনি মনোযোগ দেবেন সময় কীভাবে যাচ্ছে, ততই মনে হবে সময় আস্তে যাচ্ছে। যখন আপনি মনোযোগ দেবেন না সময় কীভাবে যাচ্ছে, হয়তো তখন চারপাশে ইন্টারেস্টিং কিছু হচ্ছে বা আপনি খুব ভালো দিবাস্বপ্ন দেখছেন—যখন আপনি এভাবে সময়ের খেই হারিয়ে ফেলেন, তখন দেখবেন সময় আগের চেয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে।”
মানুষ বলে “যখন আনন্দে থাকো তখন সময় উড়ে যায়”, কিন্ত আসলে “সময় উড়ে যায় যখন তুমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে থাকো।” তাই মজার কিছু না করলেও প্রায়ই সময় উড়ে যায়। যেমন কারো সাথে যখন তর্কে লিপ্ত থাকেন অথবা যখন আসন্ন প্রেজেন্টেশন নিয়ে চিন্তিত থাকেন।
রোভেলির এলএসডি পরীক্ষা
সময়ের বিকৃতি বুঝতে পারার একটা রহস্যময় উপায় হচ্ছে সাইকেডেলিক ড্রাগের ব্যবহার। গার্ডিয়ানের সাথে একটা সাক্ষাৎকারে রোভেলি এলএসডি নিয়ে তার পরীক্ষার কথা বলেন।
“এটা ছিল অবিশ্বাস্য জোরালো একটা অনুভূতি যা আমার বুদ্ধির জগৎকেও প্রভাবিত করেছিল। সবচেয়ে অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে একটা ছিল সময় থেমে যাওয়ার অনুভূতি। আমার মস্তিষ্কে অনেক কিছু চলছিল কিন্ত মনে হচ্ছিল সময় সামনের দিকে যাচ্ছে না। সময়ের প্রবাহ আর আগাচ্ছিল না। বাস্তবতার কাঠামোর সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত একটা ঘটনা ছিল এটা।”
দেখা যায় খুব কম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকই সময়কে বিভ্রম বলে বিশ্বাস করেন। “আমরা যেটাকে সময় বলি সেটা আসলে অনেক গভীর, অনেক স্তরীভূত একটা ধারণা, এর অনেকগুলি ধাপ আছে”, রোভেলি ফিজিক্স টুডেকে জানান। সঙ্গে আরো বলেন, “সময়ের কিছু ধাপ আছে যেগুলি কেবল নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু মাত্রায় কাজ করে। এটা এগুলিকে বিভ্রমে পরিণত করে না।”
বিভ্রম হচ্ছে সময় যে একটা পরম মাত্রায় প্রবাহিত হয় সেই ধারণা। সময়ের নদী হয়তো সব সময় সামনের দিকে প্রবাহিত হয় না, বরং এটি বিভিন্ন জনের জন্য বিভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয়। এমনকি তা ঘটে আপনার আপনার মনের মধ্যেও।
অনুবাদ: আমিন আল রাজী