এই পরিপূর্ণ গাইডলাইনে, আমরা ২০২৩ সালে এসে কীভাবে জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল অর্থাৎ কোনো বর্জ্য তৈরি না করে জীবন যাপন করা যায়, সে বিষয়ে কথা বলব।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলি থেকে শুরু করে একজন ভোক্তা হিসেবে আপনি কীভাবে সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, এই সবকিছুই আমাদের লেখায় উঠে আসবে। আমাদের পরামর্শগুলি কাজে লাগিয়ে আপনি কার্যকর উপায়ে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে আনতে পারবেন।


অ্যালেক আসগারি, পিএইচডি
আগস্ট ৮, ২০২৩
অনুবাদ: আমিন আল রাজী


জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল বা বর্জ্যশূন্য জীবনযাপন

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও পরিবেশের অবনতির কারণে সময় এসেছে ব্যক্তি ও কমিউনিটি পর্যায়ে ভোক্তা হিসেবে আমাদের আচরণ পুনর্মূল্যায়ন করার। বাস্তুসংস্থানের রেনেসাঁ নিয়ে এখন যে কথা হচ্ছে তার মূলে রয়েছে ‘জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল‘ বিষয়টি।

বর্জ্যশূন্য জীবনযাত্রা গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা যেমন প্রতিদিনের বর্জ্য কমিয়ে আনতে পারব, তেমনি সম্পদের ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। যা অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক কমিয়ে দেবে। এখানে কিছু বাস্তবিক পরামর্শ দেয়া হল, যা আপনাকে নিজের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

 

১. বর্জ্যশূন্য জীবনযাত্রার মূল বিষয়টি বোঝা

এই লাইফস্টাইলের মূলনীতি হচ্ছে, প্রতিদিন এমনভাবে জীবন যাপন করা যাতে ল্যান্ডফিল বা ময়লার আস্তাকুড়ে কিছু ফেলতে না হয়।

আমাদের প্রতিদিনের সকল বর্জ্য হয় সারে রূপান্তর করতে হবে, নয় রিসাইকেল করতে হবে অথবা পুনরায় ব্যবহার করতে হবে। তাই বিষয়টি কেবল বর্জ্য কমানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, নতুন একটা সিস্টেম গড়ে তোলা, যা আগের চেয়ে টেকসই ও পরিবেশসম্মত।

জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল

২. পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী বর্জ্য

বাজারের ব্যাগ: সবচেয়ে সহজে আপনি যে পরিবর্তনটি আনতে পারেন তা হলো বার বার ব্যবহার করা যায় এমন বাজারের ব্যাগ ব্যবহার করা। এখন এত সুন্দর ও আধুনিক পুনঃব্যবহারযোগ্য ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে, আপনি চাইলেই প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের বদলে এগুলি বেছে নিতে পারেন।

পানির বোতল: প্রতিবার প্লাস্টিকের বোতল না কিনে একটা ভাল মানের পানির বোতল ব্যবহার করুন, যেটা বার বার ব্যবহার করা যায়।

কফি কাপ: প্রতিদিন কফি না হলে কি আপনার চলেই না? তবে বার বার ব্যবহার করতে পারেন, এমন কফি কাপই বেছে নিন। এখন অনেক ক্যাফেতেই আপনি এমন কাপ পাবেন।

জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল

৩. মূল বিষয় হচ্ছে কম্পোস্ট বা জৈব সার তৈরি করা

আমরা যা কিছু ফেলে দেই, তার ৩০% জৈব সারে রূপান্তর করা যায়। সবজির উচ্ছিষ্টাংশ, কফি বা চা এর পাতা, ডিমের খোসা এসব কিছু সংগ্রহ করে রাখুন ও কম্পোস্ট তৈরি করুন। এতে আপনার বর্জ্যের পরিমাণ শুধু কমবেই না, আপনার গাছের জন্য দারুণ পুষ্টি সমৃদ্ধ সারও তৈরি হবে।

৪. ডিআইওয়াই বা ঘরে তৈরি পরিষ্কারক দ্রব্য

হাতের কাছের জিনিস দিয়ে যেমন ভিনেগার, বেকিং সোডা, লেবুর রস দিয়ে কিন্তু দারুণ পরিষ্কারক সামগ্রী তৈরি করা যায়। বাজারের প্রচলিত পরিষ্কারক পণ্যগুলি না ব্যবহার করলেও চলে।

আরো পড়ুন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত খাদ্যের এক তৃতীয়াংশ অপচয়—পরিবেশের ওপর এটি যেমন প্রভাব ফেলছে

৫. অধিক পরিমাণে কেনা

এখন অনেক পাইকারি মালামালের দোকান রয়েছে। আপনি যদি এক সাথে অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় করেন তবে সেটি যেমন প্যাকেজিং বর্জ্য কমাতে সাহায্য করবে তেমনি দীর্ঘমেয়াদে আপনার খরচও অনেক সাশ্রয় হবে।

৬. পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ডগুলিকে সাপোর্ট করুন

এখন প্রতিদিনই নতুন নতুন ব্র্যান্ড টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে কাজ করছে। এমন পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ড থেকে পণ্য ক্রয় করার মাধ্যমে আপনি ভবিষ্যৎকে আরো টেকসই করতে সাহায্য করতে পারেন।

৭. ডিজিটাল বর্জ্য কমিয়ে আনুন

ডিজিটাল জগতেও এখন নানা ধরনের দূষণ আছে। অপ্রয়োজনীয় ই-মেইল থেকে আনসাবস্ক্রাইব করুন, ডিজিটাল ফাইল গুছিয়ে রাখুন। পুরনো ও অব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র অন্য কাউকে ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিন।

৮. জিরো-ওয়েস্ট/বর্জ্যশূন্য রেসিপি ব্যবহার করুন

অনলাইনে দেখবেন জিরো-ওয়েস্ট রান্না নিয়ে এখন অনেক ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এই রেসিপিগুলি ট্রাই করলে আপনার খাদ্য সামগ্রীর বর্জ্য অনেক কমে যাবে এবং পুরো খাবারটাই আপনি গ্রহণ করবেন যা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।

৯. পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনে অভ্যস্ত হন

আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কারণে অনেক পরিবেশ দূষণ হয়ে থাকে। তাই জামাকাপড়ের ক্ষেত্রেও আপনি অনেকভাবে দূষণ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারেন। সেকেন্ড হ্যান্ড, আপসাইক্লিং (পুরনো পণ্যকে আরো মান উন্নয়ন করে তৈরি করা) এর ব্যবস্থা করুন। অথবা এমন ব্র্যান্ড ব্যবহার করুন যারা এথিক্যাল ও টেকসই পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে কাজ করে।

জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল

১০. এমন জীবন আচরণের কথা প্রচার করুন এবং নিজেও আরো জানুন

একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, আপনাকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে হবে। যত বেশি মানুষ জিরো ওয়েস্ট লাইফস্টাইলের বিষয়ে জানবে তত বেশি এর সুবিধা ও ব্যবহারিতা বৃদ্ধি পাবে। আর এই আন্দোলনের সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

১১. প্রচলিত ধারণা: বর্জ্যশূন্য মানে একেবারেই কোনো বর্জ্য নয়

বাস্তবতা: আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্জ্যের পরিমাণ কমানো, তাই আমরা কারো ওপর অবাস্তব চাপ প্রয়োগ করতে চাই না। এটা পুরোটাই হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট জীবন আচরণে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলা। নিজেদের পণ্য ব্যবহারের অভ্যাস জানা এবং এই বিষয়ে সচেতনভাবে চেষ্টা করা।

১২. প্রচলিত ধারণা: বর্জ্যশূন্য জীবনযাপন করা ব্যয়বহুল

বাস্তবতা: কিছু টেকসই পণ্য ব্যবহার শুরুতে ব্যয়বহুল মনে হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা আপনার টাকা সাশ্রয় করবে। যেমন আপনি যদি রিইউজেবল অর্থাৎ বার বার ব্যবহার করা যায় এমন সিলিকন ব্যাগ ব্যবহার করেন, যেটা একবার ব্যবহার করার মতো ব্যাগের চেয়ে সস্তা হবে। এটি বেশি দিন ব্যবহার করতে পারবেন, আপনার টাকাও বাঁচাবে (এমনকি পরিবেশও)।

আরো পড়ুন: বায়ুদূষণে হ্রাস পায় বুদ্ধিমত্তা

১৩. মিনিমালিজম গ্রহণ করুন

জিরো ওয়েস্ট লাইফস্টাইলের পাশাপাশি মিনিমালিজম জীবন দর্শন গ্রহণ করতে পারলে আপনার এই রূপান্তর আরো সহজ হবে। আপনি যদি কম ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত হন, তবে কেনাকাটার সময়ও সতর্ক থাকবেন।

১৪. পুরনো শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাগুলি নতুন করে শিখুন

আগেকার পুরনো দক্ষতা যেমন কাপড় সেলাই করা, সাধারণ কাঠের কাজ, এমনকি খাবার সংরক্ষণের বিষয়গুলি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এই বিষয়গুলি শেখার মাধ্যমে আপনি আপনার ব্যবহার্য জিনিসপত্রের আয়ু যেমন বাড়াতে পারেন তেমনি বর্জ্যের পরিমাণও কমিয়ে আনতে পারেন।

জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল

১৫. স্থানীয় কমিউনিটির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া

এলাকার মানুষদের নিয়ে একটি কমিউনিটি তৈরি করতে পারেন যারা বর্জ্যশূন্য জীবন আচরণ নিয়ে কাজ করবে। তারা অন্যদের জন্য সাপোর্ট দেবে, নিজেদের মধ্যে রিসোর্স বিনিময় করবে এবং মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।

১৬. রান্নাঘর এবং মুদি দোকানের বাইরে চিন্তা করুন

আমরা অনেক সময় ভাবি বর্জ্যশূন্য বলতে কেবল খাবারের প্যাকেজের কথা বোঝানো হয়েছে। আসলে কিন্তু তা নয়। আমাদের জীবনের অন্য অনেক কিছুতেই আমরা এই আচরণ অনুসরণ করতে পারি। যেমন ব্যবহার্য কসমেটিক্স, অফিসের জিনিসপত্র, এমনকি আমরা কীভাবে যাতায়াত করি, তাও ‘জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল’ এর অংশ।

১৭. নিজেই উৎপাদন করুন

ঘরে বিভিন্ন মশলা, ফল, সবজি উৎপাদন করা হলে যেমন সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হয়  তেমনি তা আপনাকে মানসিকভাবেও তৃপ্ত করে। এমনকি ছোট ব্যালকনিতেও চাইলে পুদিনা, ধনিয়া পাতা ফলাতে পারেন।

১৮. ব্যবহার কমান, নতুবা পুনঃব্যবহার করুন ও রিসাইকেল করুন

মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আমাদের ব্যবহার কমানো। সেটা যদি সম্ভব না হয় তবে একাধিকবার ব্যবহারের উপায় খুঁজে দেখতে হবে। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তবে সঠিকভাবে রিসাইকেল করতে হবে।

১৯. রূপসজ্জায় জিরো ওয়েস্ট উপকরণ

বর্তমান সময়ে জিরো ওয়েস্ট রূপসজ্জার উপকরণের বিশাল চাহিদা তৈরি হয়েছে। শ্যাম্পু বার বা টুথপেস্ট ট্যাবলেটের মতো নতুন সব পণ্য বাজারে আসছে। আপনি চাইলে এগুলি ব্যবহার করে আপনার কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে পারেন।

জিরো-ওয়েস্ট লাইফস্টাইল

২০. ছোট ছোট সাফল্যগুলি উদযাপন করুন

বর্জ্য কমানোর জন্য আপনার প্রতিটি সিদ্ধান্তই যেন এক একটা সাফল্য। মাঝেমধ্যে ভুল হতেই পারে, তবে এই সাফল্যগুলি আপনি উপভোগ করুন।

উপসংহার

একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব জীবন যাপনের জন্য আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে যতটা কম সম্ভব বর্জ্য তৈরি করার। আর আপনি যে’ই হন না কেন, এই উদ্দেশ্য পূরণ করা আপনার পক্ষে সম্ভব। এমন না নিখুঁতভাবে এই কাজ করতে হবে, বরং আপনার মনের ইচ্ছাটাই এখানে আসল।

পৃথিবী যতই পরিবেশগত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে, বর্জ্যশূন্য জীবন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে আমাদের সকলের ওপর। আরো বিশুদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দায় আমাদের নিজেদের। তাই ছোট ছোট পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করুন এবং ধৈর্য্য  ধরুন। আর একটা কথা মনে রাখুন, ছোট একটা কাজও আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।